শুক্রবার, ১২ই সেপ্টেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

বাবার লাশ দাফন করেই আরিফুলকে কোরবানির পশুর হাটে আসতে হলো কেন

কোহিনূর শেখ ছিলেন গরুর সঙ্গে ট্রাকের পেছনে। আর ছেলে আরিফুলকে বসিয়ে দিয়েছিলেন চালকের পাশে। কথা ছিল, ঢাকার বছিলা গরুর হাটে বাবা গরু বিক্রি করে বাড়ি চলে যাবেন। আর আরিফুল যাবে বিমানবন্দরে। বিদেশ থেকে খালা আসছেন, তাঁকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে। সঙ্গে নতুন জামাকাপড়ও নিয়েছিল সে।

কিন্তু একটি দুর্ঘটনা সব হিসাব পাল্টে দিল। টাঙ্গাইলে ট্রাক দুর্ঘটনায় বাবা ঘটনাস্থলেই মারা গেলেন। সঙ্গে থাকা ব্যবসায়ীদের হাতে গরু রেখে বাবার লাশ নিয়ে রাজশাহী ফিরে যায় আরিফুল। লাশ দাফন করে, নতুন জামাকাপড় রেখে পরদিন আবার ঢাকায় ছুটতে হয় তাকে। গরুগুলো যে বিক্রি করতে হবে!

৪ জুন সকালে বছিলা হাটে আরিফুলকে দেখা যায়। গরুর গলা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। পাশে বাবা নেই। তার দিশাহারা চোখ দুটির দিকে তাকালেই বোঝা যায়, নবম শ্রেণির ছাত্রটির কাঁধে হঠাৎই পুরো সংসারের বোঝা এসে পড়েছে।

‘যমুনা সেতু পার হয়েছি, মা’
কোহিনূর শেখের বাড়ি রাজশাহীর বাঘা উপজেলার নীচ পলাশী ফতেপুর গ্রামে। তাঁর তিন ছেলেমেয়ে। দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে। নদীভাঙনে নিঃস্ব কোহিনূর নিবন্ধিত জেলে। পদ্মা নদীতে মাছ ধরে, কৃষিকাজ করে সংসার চালাতেন। ১০ থেকে ১৫ বছর হলো প্রতি কোরবানির ঈদে হাটে তোলার জন্য তিন–চারটি করে গরু পালতেন। এবার তাঁর গরু ছিল তিনটি।

কোহিনূরের ভাগনে রেজাউল করিম জানালেন, প্রবাসী এক আত্মীয়ের কাছ থেকে টাকা ধার করে গরু পালতেন কোহিনূর। হাটে গরু বিক্রি করে টাকা ফেরত দিতেন। রেজাউল বলেন, ‘স্থানীয়ভাবে বিক্রি করলে ব্যবসায়ীরা নগদ টাকা দেন না। কখনো এসে বলেন, লোকসান হয়েছে। ঠিকমতো টাকা দিতে চান না। আবার ব্যাপারী প্রভাবশালী হলে টাকা তুলতে সালিস–দরবারও করতে হয়। এই অভিজ্ঞতা থেকে কয়েকজন ব্যবসায়ী মিলে ট্রাক ভাড়া করে গরু নিয়ে সরাসরি ঢাকায় যান। নগদ টাকায় বিক্রি করে আবার ফিরে আসেন।’

বাবার লাশ দাফন করে, পরদিন আবার ঢাকায় ছুট আসতে হয়েছে আরিফুলকে, গরুগুলো যে বিক্রি করতে হবে
বাবার লাশ দাফন করে, পরদিন আবার ঢাকায় ছুট আসতে হয়েছে আরিফুলকে, গরুগুলো যে বিক্রি করতে হবেছবি: জাহিদুল করিম
কোহিনূরের মেয়ে আমেনা খাতুন জানান, গত ৩১ মে দিবাগত রাত ১২টার দিকে বাবার সঙ্গে তাঁর শেষ কথা হয়। ফোনে কোহিনূর মেয়েকে বলছিলেন, ‘যমুনা সেতু পার হয়েছি, মা। আমার ফোনে টাকা নাই, তুমি ফ্লেক্সি দিয়ো। সকালে দিলেও হবে।’ সেই সকাল তাঁর জীবনে আর আসেনি। এর ঘণ্টাখানেক পরই দুর্ঘটনা
কয়েক বছর আগেও আরিফুলদের পরিবারের অবস্থা এমন ছিল না। নদীভাঙন এই পরিবারের স্বপ্নেও ভাঙন ধরিয়েছে।

আমেনা জানান, তাঁর বাবার ছয়–সাত বিঘা আবাদি জমি ছিল। সব নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। যেকোনো সময় তাঁদের বাড়িটাও নদীতে ভেঙে যাবে। এবার ভাঙলে তাঁদের আর যাওয়ার কোনো জায়গা থাকবে না।

শুধু মাছ ধরে সংসার চলে না। পদ্মা নদীতে আগের মতো আর মাছ পাওয়াও যায় না। তাই কোহিনূর জমি বর্গা নিয়ে সাড়ে চার বিঘা জমিতে পেঁয়াজ চাষ করেছিলেন। এবার পেঁয়াজের দাম ছিল না। প্রায় তিন লাখ টাকা লোকসান হয়েছে। সব ঋণের টাকা। ঋণ শোধ করতে হলে গরু তিনটি বিক্রি করতেই হবে। বাধ্য হয়ে এই গুরুদায়িত্ব কাঁধে নিতে হয়েছে স্কুলপড়ুয়া আরিফুলকে।

আমেনা বলেন, ‘ভাইডা আমার নিঃস্ব, এতিম হইয়া গেল। আমার বাপের কোনো ভাই ছিল না। আরিফুলও একা। আমাদের আর কোনো অভিভাবক নেই। কানতে কানতে মায়ের গলা ভাইঙি গিছে। গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না।’

[print_link]